দেবীদ্বারে যান্ত্রিকীকরণে চাষাবাদ উদ্বুদ্ধ করতে এবং নতুন উদ্ভাবনী ব্রি ধান- ১০২ চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় কৃষিবিভাগ।
কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ইউছুফপুর গ্রামের একটি ফসলী মাঠের ৫০ একর জমিতে বোরো মৌসুমে ব্রি ধান- ১০২ ’সমলয়ে চাষাবাদে’ যান্ত্রিকীকরণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে ওই চাষাবাদ করা হয়েছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দেশের সর্বোচ্চ লক্ষমাত্রা নির্ধারনে ১শত একরের একটি কৃষি মাঠের ৫০ একর জমিতে নতুন উদ্ভাবনী এ (ব্রি ধান-১০২) ধান আবাদ করেছেন কৃষকরা। নতুন জাতের ধান ব্রি ধান-১০২ চাষ করে কৃষক লাভবান হয়েছে। ব্রি ধান-১০২ চাষ করে কৃষকের মুখে আনন্দের ঝলক মিলেছে।
এই কর্মসূচির আওতায় সিডলিং ট্রেতে চারা তৈরি করে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের সাহায্যে চারা রোপন করা হয়েছে। সেচপাম্পে পানি সরবরাহ এবং কম্বাইন হাভেস্টার মেসিনের সাহায্যে উৎপাদিত ফসল একই সাথে ধান কাটা, ধান মারাই ও বস্তাবন্দী করে ঘরে তুলছেন কৃষকরা।
ইউসুফপুরের সমলয় চাষাবাদের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, কৃষক কৃষানীরা কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেসিনে ধান কেটে, মারাই শেষে বস্তায় ভরে মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরছেন। কৃষকরা জানান, যান্ত্রিকীকরণে মজুরীর টেনশন থাকেনা, স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং ফসলের লাভ নিয়ে ঘরে ফেরা যায়।উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ব্রি ধান- ১০২ জাতটি জিংক সমৃদ্ধ; যাতে জিংক এর পরিমাণ ২৫.৫ মি. গ্রাম/কেজি। তাছাড়া, জাতটির অ্যামাইলোজ ২৮% ও প্রোটিনের পরিমাণ ৭.৫%। ফলে এ ধানের চাল চিকন ও সাদা হওয়ার পাশাপাশি ভাত ঝরঝরে হবে। বিঘা প্রতি প্রায় ২৫ থেকে ২৬ মন ফলন দিতে সক্ষম ব্রি ধান-১০২ জাতটি। কৃষক মনুমিয়া জানান, প্রতি একর জমিতে গড়ে ৯১ মণ করে ধান পাচ্ছেন তারা। কোন কোন জমিতে যা বেড়ে দাড়িয়েছে ১০০ মণ, অর্থাৎ প্রতি শতাংশে এক মণ। যন্ত্রের সাহায্যে অল্প বয়স্ক (৩০ দিন) বয়সী চারা রোপনের ফলে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ভালো ফলনের মূল কারণ হিসাবে কৃষকরা জানান। কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, জাত হিসাবে ব্রি ধান ১০২ এর উফশী বৈশিষ্ঠ্য ফলন বৃদ্ধির নিয়ামক। হাতে লাগানো জমিতে গড়ে ফলন পাওয়া গেছে ৭৩ মণ। অর্থাৎ ৫০ একরে প্রায় ৯০০ মণ অতিরিক্ত ধান উৎপাদিত হয়েছে সমলয়ের মাঠ থেকে। যার বাজার মূল্য সরকার নির্ধারিত ৩৬ টাকা প্রতি কেজি হিসাবে ১২ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা।
তাছাড়া, যন্ত্রের সাহায্যে রোপন ও কর্তনের ফলে অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছে কৃষক। সরকারিভাবে রোপন ও কর্তনের ব্যয় বহন করা হলেও বাজার মূল্য বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে একর প্রতি সাশ্রয় হয়েছে ১৯ হাজার ৮ শত ১৫ টাকা। যা ৫০ একরে দাড়ায় ৯ লক্ষ ৯০ হাজার ৭ শত ৫০ টাকা। অর্থাৎ, ৫০ একরের সমলয় চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকদের সর্বমোট ২২ লক্ষ ৮৬ হাজার ৭ শত ৫০ টাকার অতিরিক্ত ফসল ও অর্থ সাশ্রয় হয়েছে ।
স্থানীয় কৃষক এমদাদুল হক জানান, আমাদের যান্ত্রিকীকরণের আগে প্রতি বিঘা জমি রোপণ করতে পানি সরবরাহ, হাল চাষে শ্রমিক খরচ হতো ৮ থেকে থেকে সাড়ে ৮ হাজার টাকা, সময়ও লাগত ২/৩ দিন। আর যান্ত্রিকীকরণে শ্যালু মেসিনে পানি সরবরাহ, ট্রক্টরে চাষ এবং সিডলিং ট্রেতে চারা তৈরি করে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের সাহায্যে রোপণ করলে বিঘা প্রতি ১ হাজার ৫ শত থেকে ১ হাজার ৭ শত টাকা খরচ হবে। সময় লাগে মাত্র এক ঘন্টা। ধান পাকা শেষ হলে হার্ভাস্টার মেসিনে একসাথে কাটা, মারাই এবং বস্তাবন্দীতেও সময় এবং খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। তার থেকেও বড় কথা প্রয়োজনের সময় শ্রমিক পাওয়া যায় না। অনেক সময় বিভিন্ন কারণে শ্রমিক মজুরি দ্বিগুণ হয়ে যায়। যান্ত্রিকীকরণে এ সব দুশ্চিন্তা থেকে আমার মুক্ত।
ব্রি ধান- ১০২ জাতটির বিষয়ে কৃষকদের আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে বøকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম জানান, গত বছর পার্টনার প্রোগ্রামের মাধ্যমে এক একরের একটি ব্রি ধান- ১০২ প্রদর্শনী বাস্তায়ন করি। জমির ফলন দেখে এ বছর ৫০ একরন জমিতে কৃষকেরা নিজেরাই ব্রি ধান- ১০২ চাষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ বানিন রায় জানান, মূলত: দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ‘সমলয় চাষাবাদের’ বøক প্রদর্শনীটি বাস্তবায়ন করছি। প্রথমত, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ; বিশেষ করে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের ব্যবহারকে জনপ্রিয়করণ, দ্বিতীয়ত, বোরো ধানের নতুন জাত হিসাবে প্রোটিনসমৃদ্ধ ব্রি ধান- ১০২ সম্প্রসারণ। তাছাড়া, রোপনের পর এ ডবিøউ ডি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষকদের অভ্যস্ত করতে কার্যক্রম চলমান থাকবে। তবে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো,-গত বছর কয়েকজন কৃষককে অনেকটা জোরপূর্বক ব্রি ধান-১০২ চাষে উদ্বোদ্ধ করতে হয়েছে। এবার ব্রি ধান- ১০২ এর উৎপাদন এবং গুণাগুনে কৃষকরা আগ্রহী বেশী হওয়ায় একই মাঠে প্রায় ৫০ একর জমিতে ব্রি ধান-১০২ চাষ হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ। আগামীতে প্রায় ১০০ একরের সমলয় চাষাবাদের বিষয়ে কৃষকগণ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেই সাথে জিংক সমৃদ্ধ ব্রি ধান- ১০২ এর চাল গ্রামবাসীর পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুৃল হাসনাত খান জানান, সমলয় চাষাবাদের ফলে কৃষকের পরিশ্রম, সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়, অন্যদিকে ফলন বৃদ্ধি পায়। দেবীদ্বারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অনেক। আগামীতে কৃষকের উন্নয়নে সকল কার্যক্রমে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করবো। দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় এ ধরণের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।